Last Updated on November 11, 2021 by SM Toukir Ahmmed
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা সব সমালোচনা, মন্তব্য, ফেইসবুক পৌস্ট-ই আমজনতাদের উত্তেজিত করলেও সকল সমালোচনা, মন্তব্য, ফেইসবুক পৌস্ট-ই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে ধাবিত করেনা। এমন দাঙ্গা যা সমাজের কয়েকটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘটে থাকে, যেখানে সাধারণ জনগণ মারমুখী অবস্থানে থাকে। আমার গবেষণার মতে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর্যায়ে যাবে কিনা তা নির্ভর করে আসলে সমালোচনা, মন্তব্য, ফেইসবুক পৌস্ট গুলো কি চোখের আড়ালে হয়েছে কিনা তার উপর। আবার “চোখের আড়ালে” হওয়া কর্মকাণ্ডগুলোকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে আসলে উক্ত সমালোচনা, মন্তব্য, ফেইসবুক পৌস্ট যদি লুকিয়ে অথবা মন্দিরে বা মন্দিরের বাইরে অন্য ধর্মের লোকদের পবিত্র গ্রন্থ লুকিয়ে রেখে করা হয়ে থাকে তাহলে এর মানে দাঁড়ায় কোনো সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠী ইচ্ছা করেই এই ঘটনা করিয়েছে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য, এখানে ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের কোনো ভূমিকাই নেই।
ধর্ম এমন একটা জিনিস যা অধিকাংশ মানুষ বাছাই করে থাকে নিজেকে জ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বা জাহির করার জন্য। ধর্ম নিয়ে চাইলে যে কেউই বলতে পারেন। আর এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে যেকোনো জায়গা থেকে কপি-পেইস্ট করে দিলেই হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো তারা অডিয়েন্স, পরিবেশ, অবস্থান ইত্যাদি জিনিসগুলো বিবেচনা করে থাকেননা। আর ধর্মের কথা শুনলেই সকলের মনে একধরনের শ্রদ্ধা , ভয় কাজ করে। যে কেউ ধর্মের কথা বলার এই মানে নয় যে তিনি মানুষ হিসেবে সঠিক, সৎ। অনেকেই আছেন আমাদের সমাজে যারা ব্যাক্তিগত আক্রোশ, প্রতিশোধের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেন। এইজন্য গরম না হয়ে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া আবশ্যক।
আমরা যদি ইতিহাস দেখি তাহলে বুঝতে সহজ হবে যে, কিছু মন্তব্য, আচরণ, সমালোচনা, খোঁচা মারা যখন সরাসরি হয়ে থাকে তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায় থাকে। অবশ্যই একটা পক্ষকে উত্তেজিত করে, কিন্তু এইজন্য অমুসলিমদের বাছাই করে আঘাত করতে হবে, সম্পদ লুটপাট করতে হবে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা প্রায় দেখাই যায়না। আবার এটা অবশ্যই বলা উচিত যে, যারা না লুকিয়ে সরাসরি করে থাকেন তাদের বেশিরভাগের উদ্দেশ্যই থাকেনা দাঙ্গা বাধানোর। তারা এটা বলেন জ্ঞানী হিসেবে প্রচার করার জন্য, সমালোচক হওয়া অথবা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। বাংলাদেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে প্রকাশ্যে টিভি চ্যানালে, সংবাদপত্রে, নিজেদের ব্লগে এমন অনেক মন্তব্য, লেখা লিখে থাকেন যা বেশিরভাগ সময়ে ধর্মকে হেয় করার জন্য হয়ে থাকে। তখন অবশ্যই একটা পক্ষ আন্দোলন করে, তীব্র নিন্দা জানায়, প্রতিবাদ করে, বয়কট করে কিন্তু ভয়ানক ধরনের ঘৃণা বা দাঙ্গা করার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়না। তখন ব্যাক্তির প্রতি মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ হয়, একটা পক্ষ ব্যাক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তখন অন্য ধর্ম, পরিষ্কার করে বললে হিন্দু ধর্মের মানুষদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা কেউ বিপক্ষে অবস্থান নেয় না। বাংলাদেশে এমন অনেক ব্লগার ছিলেন যাদের বিরুদ্ধে আমজনতাদের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু তখন অন্য ধর্ম বা ব্লগারের ধর্মের বিরুদ্ধে দাঙ্গা, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সম্পদ ধ্বংস লুটপাট করার মতো ঘটনা তেমন একটা পরিলক্ষিত হয়না।
উদাহরণ হিসেবে বললে, অনেক কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি, সমাজে প্রতিষ্ঠিত তারা প্রায় সময় ধর্মের ব্যাপারে মন্তব্য করে থাকেন। কিন্তু এজন্য কিন্তু কোনো দাঙ্গা ঘটেছে তার খবর পাওয়া যায়না। আরো লক্ষণীয় ব্যাপার হলো যে এই মন্তব্যের জন্য অন্য অমুসলিমদের এমনকি অন্য জায়গার অমুসলিমদের আঘাত করা হবে এমন চিন্তাও মাথায় আসেনা। তাহলে এক্ষেত্রে আমজনাতাদের বিশেষ করে মুসলমানদের মাথায় রাখা উচিত যে, যখনি এমন ধরনের মন্তব্য বা কাজ কেউ সরাসরি করে থাকেন তাহলে সেটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর জন্য হয়ে থাকেনা। আর সরাসরি, প্রকাশ্যে হয়ে থাকলে তখন যেমন মুসলমানরা উক্ত ব্যাক্তির প্রতি রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ করা বা বিচার প্রত্যাশা করেন ঠিক একইভাবে অপ্রকাশ্যে এমন ঘটনা ঘটে থাকলে শুধুমাত্র ব্যাক্তি বা ব্যাক্তিদের উপর আইন মেনে ক্ষোভ প্রকাশ করা উচিত। নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়া উচিত না। আর যদি তারা নিজেদের হাতে আইন তুলে নেন তাহলে এটাকে বিপক্ষে ব্যবহার করে অনেকেই বিপ্লব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবেন। বিশেষ করে অনেক শক্তিশালী দেশ রয়েছেন তারা এটাকে বিপ্লব হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করে থাকবেন। আর এই ধরনের দাঙ্গা, হামলা প্রতিটি সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিশ্বাস, সম্পর্ক নষ্ট করে থাকে যার সুযোগ অন্য দেশ নেয়ার চেষ্টা করে। যদিও প্রকাশ্যে কেউ এমন ধরনের অন্যায় করে থাকলেও ঐ এলাকার অনেকের ওপর এর প্রভাব পরে তারপরও দাঙ্গা বাধানোর মতো পরিবেশ তৈরি হয়না। কারোর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা একটি মারাত্মক অপরাধ, যা প্রায় সময়ে সাম্প্রদায়িক হামলা-দাঙ্গার মতো ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করে। ধর্মীয়মতবাদকে আঘাত করে বেশিরভাগ সময়ে বিনা “ইনেভস্টমেন্টে” কোনো একটি পক্ষ সর্বদা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার সুযোগ নিয়ে থাকে। সামাজিকভাবে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি আমজনতার মধ্যকার একটি পক্ষ গরম হয়ে যায়। আর এই গরম পরিবেশের সুযোগ নিয়ে আরেকটি পক্ষ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে নিজেদের স্বার্থের জন্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করার।
সামাজিকভাবে এবং মানসিকভাবে বিশ্লেষণ করলে, এমন দাঙ্গার পরিবেশ যাতে করে সৃষ্টি না হয় সেজন্য সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। নিয়ম, আইন করে এমন পরিস্থিতি অনেকটা রুখে দেয়া যায়; অবশ্যই সঠিক ও কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। যখনি এমন ঘটনা ঘটে তখন একধরনের লোক থাকে প্রায় সব ধর্মের যারা লুটপাটের জন্যই অপেক্ষা করে থাকেন। তাই সরকারকেই ভূমিকা নিতে হবে। যদিও সরকারেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে তারপরও সরকারের সক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি।
সরকার যা করতে পারেঃ
১। কেউ যাতে কারোর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে না পারে সেজন্য কঠোর হওয়া।
২। এমন ঘটনা, ফেইসবুক পৌস্ট যেকোনো কিছু ঘটে থাকলে স্থানীয় থানায় জানানো বাধ্যতামূলক। থানার কর্মকর্তারা অবস্থা বুঝে, তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, এজন্য ২৪-৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় দেয়ার নিয়ম করা।
৩। ওয়াজ, মাহফিলে এমনকি অন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কেউ যেনো উস্কানিমুলক বক্তব্য প্রদান না করে সেই নিয়ম করা। যদি ধর্মীয় ব্যাক্তি, স্কলাররা তেমন বাহাস করতে চান সেটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আয়োজন করা। এছাড়া এর এখতিয়ার সাধারণ জনগণকে না দেয়া। ধর্মীয় স্কলারদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বাহাসের ঘটনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
৪। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম অথবা ধর্ম নিরপেক্ষ যেটাই বিবেচনা করা হোক না কেনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া শাস্তিমূলক অপরাধ। এর জন্য আইন তৈরি করা এবং তা প্রয়োগ করা আবশ্যক।
৫। প্রতিটি থানায় বলে দেয়া, এমন ঘটনা ঘটলেই যেনো তারা অন্ততপক্ষে দ্রুততার সাথে উপস্থিত হন।
৬। আদালতের মাধ্যমে বিচার করা।
৭। শাস্তি হিসেবে জেইল, জরিমানা, বরখাস্ত, মুচলেছা দেওয়া।
আমজনতা যা করতে পারেঃ
১। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে মুসলমানদের আরো স্বাভাবিক আচরণ করা। তদন্ত, কারণ জানার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করা।
২। স্ব স্ব থানায় জানানো। মাঝে মাঝে ভুল করে, না জেনে অনেকেই ফেইসবুকে পৌস্ট করে থাকেন। তাই যাচাই-বাছাই না করেই কোনো প্রকার আইন হাতে তুলে না নেওয়া।
৩। ধর্মীয় জিনিস নিয়ে কেউ কিছু বলে থাকলে তাকে আমন্ত্রণ জানানো আলিমদের সাথে বাহাসের জন্য।
পরিশেষে, এটাই বলা যায় যে, বাংলাদেশ এমন একটি ভৌগলিক অবস্থানে রয়েছে যে এর গুরুত্ব রয়েছে অনেক দেশের কাছে। তাই অনেক দেশ কিছু মানুষকে অন্যায়ভাবে হাতে রাখার জন্য ধর্মকে যাতে করে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে সবার নজর রাখা উচিত। আরেকটা কথা না বললেই নয় যে বাংলাদেশের অশিকাংশ ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধর্মকে ব্যবহার করে থাকেন। কারণ তারা মানুষদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টা করেন। আবেগ আর আমরা খুব ধার্মিক এমন প্রচার করে থাকলে মানুষকে বশে আনা যায় খুব সহজে। এক্ষেত্রে কোনো কিছু ইনভেস্ট করা লাগেনা। একবার ‘আগুন’ লাগিয়ে দিলেই হলো। যদিও অনেক রাজনৈতিক দলগুলোও এমন সুযোগ নিয়ে থাকেন তবুও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এব্যাপারে নজর দেয়া আবশ্যক। বাংলাদেশের শিক্ষা, সচেতনাতা, শিক্ষিত ছাত্র সমাজ, রাজনৈতিক ব্যাক্তি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, জ্ঞানী ধর্মীয় স্কলাররাই পারেন বাংলাদেশকে রক্ষা এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে। বাংলাদেশ সবার, শুধুমাত্র কোনো ব্যাক্তি, জাতি, ধর্ম গোষ্ঠীর না।